বিয়ে থা পর্ব-৩৪

0
115

#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

সময় গড়িয়েছে। রাত দশটা। দুজন কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়েছে। একটু আগে ফারিন দুজনের খাবার দিয়ে গেছে উপরে। নিনীকা শক্ত হয়ে বিছানায় বসে। ধ্রুব নিজেই ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দিলো। নিনীকা বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলো। ধ্রুব খেতে খেতে বলল,

‘ কেন এতো অবাধ্য হচ্ছো মিসেস? আমাকে কি এতোদিনে একটুও বিশ্বাস করতে পারোনি? তবে কেন বলেছিলে ভালোবাসো? ‘

নিনীকা টলমল চোখে তাকালো,

‘ আপনাকে আমি ভালোবাসি এবং সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসও করি। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না, ব্যাপার টা আমার মা বাবার বিষয়ে। তিনি যতোই খারাপ হোন তাকে আর কারো কাছে খারাপ প্রমাণ করতে আমি চাই না। আপনাকে কি করে আমি সব বলি! ‘

ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাওয়া শেষ করলো। ডিম লাইট অন করে এসে শুয়ে পড়লো ফুলে সজ্জিত বিছানায়। নিনীকা বুকে আছড়ে পড়লো। ধ্রুবের পড়োনের টি-শার্ট টেনে খুলে রাগে ছুঁড়ে ফেললো রুমের এক কোণে। উন্মুক্ত বুকে দাঁত দিয়ে দংশন করে নিজের রাগ, চাপা অভিমান কমাতে চেষ্টা করলো। ধ্রুব মাথায় হাত ভুলিয়ে শান্ত করতে চাইলো।

‘ শান্ত হও, বলতে হবে না কিছু। ‘

নিনীকা ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে কেঁদে ফেললো। ধ্রুব চোখের পানি মুছে দিলো।

‘ হুস কাঁদে না। ‘

‘ আপনাকে আমি বলবো, তবে কখনো তারা যাতে জানতে না পারে আপনি সব জানেন। ‘

ধ্রুব বউয়ের পড়োনের শার্ট ঘরের আরেক কোণে ছুড়ে ফেললো। নিজের উপর সমস্ত ভর নিয়ে হাতের বন্ধন শক্ত করে বলল,

‘ কেউ জানবে না। ‘

নিনীকা মাথা এলিয়ে দিলো।

‘ আমার আগমনী বার্তা শুনে বাবা খুশি হননি। কেন হননি জানি না। মা বলেছেন তাদের লাভ ম্যারেজ। বাবা ও তিনি একই ক্লাসে ছিলেন। সমবয়সী তারা। প্রথমে বন্ধুত্বের মতো সম্পর্ক গড়ে উঠে, তারপর প্রেম। আবেগের বয়স থেকে তাদের প্রেম বাবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত চললো। তারপর পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হলো। বাবার বাবা মানে আমার দাদার অঢেল সম্পত্তি ছিলো। বাবা স্টুডেন্ট হলেও বেকারত্ব গুছিয়ে ফেলতে চেষ্টা করেছেন দাদার ব্যবসায় ঢুকে। ভালো বংশ, ছেলে ভালো। তার উপর কতো বছরের সম্পর্ক তাদের। সবাই রাজি হবেন স্বাভাবিক। আর আমার নানা মশাই তেমন রাগী মানুষ ও ছিলেন না। আগের যুগ হলেও মেয়ের মতামতের গুরুত্ব ছিল তার কাছে। ব্যস মা বাবার বিয়ে হয়ে যায়। বাবা নাকি মাকে অনেক ভালোবাসতেন। চিঠিপ্রেম ও বাদ যায়নি। তাদের যখন প্রতিষ্ঠান আলাদা হয় প্রেম চলাকালীন তখন নাকি বাবা শহরে বেশিদিন থাকতে পারতেন না। ছুটে গ্রামে এসে লুকিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতেন। বিয়ের পরও বাবার সেই প্রেম এক চিমটিও কমেনি। কিন্তু বিয়ের পাঁচ মাস পর বাবা বদলে যান।

তিনি হোস্টেলে ছিলেন। মাকে ফোন করেছিলেন পরীক্ষা শেষ তিনি ফিরবেন। মা আমার আগমনের সংবাদ ফোনে দিলেন না। বাবাকে বলেছিলেন সারপ্রাইজ দিবেন। বাবা কথা রাখেন নি। পরের দিন বাড়ি ফিরেন নি। তার চার পাঁচ দিন পর বাড়ি ফিরেন। তখন তিনি মায়ের সেই প্রেমিক ছিলেন না, ছিলেন হিংস্র কোনো পশু। সেই যে বাবা বদলে গেলেন। মায়ের উপর তার হিংস্রতা ছিল মাত্রাধিক। আমার আসার খবর শুনে তিনি নাকি মাকে চড় মেরেছিলেন। অথচ এই তিনিই বাসর রাতে স্ত্রীর সাথে কথা বলেছিলেন, তার প্রথম সন্তানের নাম হবে নিনীকা শেখ।

আমার যখন জন্ম হলো তখন নাকি বাবা কোলে নেন নি। আমার এখনো মনে আছে, তখন কতোই বা বয়স হবে চার কি পাঁচ। বাবার কোলে উঠার বায়না করতাম। বাবা নিতেন না। মাঝে মধ্যে যখন আমি ঘরে একা থাকতাম তখন নিতেন। আবার নির্দয় ভাবে ছুঁড়েও ফেলতেন। আমি ব্যথায় ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতাম। তুমি ‘পচা বাবা’ বলে অভিযোগ করতাম।

একটু একটু করে বড়ো হচ্ছিলাম। আমার কাছে একজন ঘৃন্য লোক হলেন আমার বাবা। আমারই সামনে তিনি আমার মাকে অমানুষিক অত্যাচার করতেন। বন্ধ দরজার ভেতর থেকে আমার কানে ভেসে আসতো মায়ের চিৎকার। আট বছর বয়সেই আমাকে আলাদা ঘরে দেওয়া হলো। রাতের আঁধারে আমি মা মা বলে চিৎকার করে কাঁদতাম। কিন্তু মা আসতে চাইলেও বাবা আটকে রাখতেন।

আমার সাথে কেউ মিশতো না। স্কুলে যেতাম গাড়ি করে, আসতামও গাড়ি করে। কারো সাথে কথা বলতাম না। সবার বাবা তাদের স্কুলে নিয়ে যেতো। আমার বাবা যেতো না। সে কখনো আমার জন্যে চকলেট নিয়ে আসতো না। আমার পছন্দের চিপস খাওয়া বন্ধ করে দিতে হয় তার জন্য। আমার যা পছন্দ হতো, তা তিনি আমার থেকে কেঁড়ে নিতেন। পছন্দের পুতুল, পছন্দের খেলনা। আমি যখন ক্লাস এইটে তখন আমার একটি ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়। আমাদের বাড়ির পাশের বিল্ডিংয়ের একটি ফ্ল্যাটে ওরা নতুন এসেছিলো। আমি ওর সাথে মাঠে খেলতে যেতাম। বাবা অফিসে গেলে বের হতাম, ফিরে আসতাম তার আসার আগে। মাঝে মধ্যে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ওর সাথে খেলতে চলে যেতাম। মা বারণ করতেন। বাবা জানলে রক্ষে থাকবে না। কিন্তু বাবা কিভাবে যেনো জেনে গেলেন। ওই ছেলেটাকে আমার সামনে প্রচন্ড মারলেন। ক্ষমতার জোরে ওদের শহর ছাড়া করে ছাড়লেন। আমাকে টেনেহিঁচড়ে ঘরে এনে ছুঁড়ে ফেললেন। বললেন, ‘ ছেলেদের থেকে যেনো দূরে থাকি। কোনো পুরুষ যেনো আমার আশেপাশে ও না আসে। ‘

আমি ভাবলাম হয়তো বাবা অন্য কিছু আন্দাজ করে এটা বলেছেন। বুঝাতে চেষ্টা করে বললাম, ‘ও শুধু আমার বন্ধু হয় বাবা, আমরা একসাথে প্রতিদিন মাঠে আরও ছেলেমেয়েদের সাথে খেলাধুলা করি। ‘

বাবা আমাকে দুদিন ঘরবন্দী করে রেখেছিলেন। মাকেও আসতে দিতেন না। দু’দিন পর আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কোনো ছেলে আমাকে প্রপোজ করলে আমি ভয়ে কাউকে বলতাম না। বাবার কানে গেলে ওই ছেলেগুলোর অবস্থা খারাপ করে দিতো। আমি পাবলিকে চান্স পেলাম। হোস্টেলেই থাকতাম বেশিরভাগ। অনেক ছেলে মেয়েই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। আমি পাত্তা দিতাম না।

টিউশনি করাতে শুরু করলাম। নিজের হাত খরচটা জুটে যেতো। ফাইনাল ইয়ার শেষ করে বাড়িতে তখন। আচমকা বাবা বিয়ে ঠিক করেন। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। মাকে ইমোশনাল ব্লেকমইল করলাম। সে আমাকে পাসপোর্ট এনে দিলো। ঠিক করলাম রমজান শেখের মান ইজ্জত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে চলে যাবো।

বিয়ের দিন আমাকে পালাতে সাহায্য মা-ই করেছেন। বেলকনি দিয়ে বাগানে, বাগান থেকে লুকিয়ে বের হয়ে সিএনজি ধরে নিজের পরবর্তী গন্তব্যে।

বাবার পছন্দের প্রতি কখনোই আমার ভরসা ছিল না। আমার ধীরে ধীরে একটা ফোবিয়া তৈরি হয়ে গেছিলো। আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। ছেলেদের তো নয়ই। প্রত্যেক মেয়ের জীবনে বাবা হয় প্রথম পুরুষ। তার থেকেই পুরুষদের ব্যাপারে ধারণাটা প্রথম পাওয়া যায়। আমার ধারণা পাওয়াটা তেমন ভালো ছিল না। আমি দেখেছি কিভাবে একজন পুরুষ স্বামী নামক ট্যাগ শরীরে লাগিয়ে দিনের পর দিন নিজের স্ত্রীর উপর জঘন্য সব নির্যাতন করে। আমি দেখেছি একজন পাষণ্ড বাবাকে।

সুমিত্রার সাথে পরিচয়টা অনলাইনে হয়। টুকটাক কথা হতো। একসময় সম্পর্ক গাঢ় হয়। আমার জীবনে একজন বন্ধু হয়। ওকে আমি সব শেয়ার করি বিশ্বাস করে। আমি সেদিন ভেবেছিলাম ও হয়তো আপনাকে সব বলে দিয়েছে। সেজন্য ওভাবে রেগে গেছিলাম। আপনার মায়ের সাথে ঝগড়া শুরু করেছিলাম ঠিক, তবে সর্বোচ্চ রাগ তখন হয় যখন তিনি মা বাবা নিয়ে কথা বলেন।

দীর্ঘ কথা বলে থামলো নিনীকা। তার চোখেমুখে কষ্টের চাপ। ছলছল চোখে ধ্রুবর দিকে মুখ তুলে তাকালো।

‘ আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না, বদলে যাবেন না। কথা দিন। ‘

ধ্রুব দু’হাতে মুখ তুলে কাছাকাছি আনলো। কপালে গভীর ভালোবাসা নিয়ে চুম্বন করলো।

‘ তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে আমার হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে যাক, পৃথিবী থেকে ধ্রুব নামটি মুছে যাক। ‘

নিনীকা কিছু একটা ভেবে বলল,

‘ আমি আপনার মা বাবাকে দেখে, আপনার আমার প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব দেখে এতোটুকু বুঝেছি এক জনমের অর্ধেক সময় অবহেলায় কাটলেও বাকি সময়টা ভালোবাসাতেই কেটে যাবে। আমার এই ধারণাটা যেনো কখনো বদলে না যায়। এটার দায়িত্ব আমি আপনাকে দিলাম। ‘

‘ দায়িত্ব নিলাম তবে। ‘

নিনীকা তলপেটে চাপ অনুভব করলো। ধ্রুব নেশালো কন্ঠে শুধালো,

‘ পৃথিবীর সবকিছু ভেসে যাক, সবাই ছেড়ে চলে যাক। বদলে যাক সবকিছু। আমি মেজর ধ্রুব মাহবুব কথা দিচ্ছি সারাজীবন মিসেসের দেওয়া দায়িত্ব পালন করে যাবো ভালোবেসে। ‘

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here