প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব ৬

0
119

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৬

” তোমার কি মনে হয় আমাকে অপমান করা মেয়েটাকে আমি আমার সাথে সাথে নিয়ে ঘুরব সারাক্ষণ? আমার কথা ভাবতে কে বলেছে তোমায়? আমি বলেছি তোমাকে কখনো? তুমি আমার বাবার পছন্দ বলেই আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি, ইচ্ছে হলে ভেঙেও দিতে পারি এটা আমার কাছে বড়ো বিষয় না। তুমি আমার ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে আসবে না একদম। তোমার সাথে মাস দুয়েক সময় কাটিয়ে অন্যদের থেকে আলাদা মনে হয়েছিল কিন্তু যেই লাউ সে কদু বেরিয়ে আসলে। আমি আমার ওপর আঙুল নাচানো মানুষ বরদাস্ত করব না। ”

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে এশা। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে, স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে এশার সবগুলো কথা শুনতে থাকে আবরার।
আবরার ভীষণ ঠান্ডা মেজাজের পুরুষ। সহজে কোনোকিছু তাকে উত্তেজিত করতে পারে না। তাই এশার এতোগুলো কথাও আবরারকে টলাতে পারেনি। আবরার আগের মতো স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে।

আবরারকে চুপ থাকতে দেখে এশা আবারও বলে ওঠে,” দেখো আবরার, আমি আমার বাবাকেও এসবে সহ্য করতে পারি না আর তুমি তো বাহিরের কেউ। বাহিরের কেউ বলছি কারণ আমাদের বিয়ে এখনো হয়নি আর বিয়ে হলেই বা কি তুমি যখনই আমাকে তোমার ইচ্ছেতে চলতে বলবে সেদিনই আমাদের একসাথে শেষদিন হবে৷ তুমি নিশ্চয়ই আমার রাগ,জিদ সম্পর্কে জেনে গিয়েছ? তোমার যদি মনে হয় আমি যেমন সেভাবেই আমাকে বিয়ে করে সারাজীবন থাকতে পারবে তাহলে আমার জীবনে তোমাকে স্বাগতম আর যদি না পারো তাহলে ধন্যবাদ, তুমি এখন আসতে পারো।”

আবরার এতক্ষণে দুইহাত বুকের দুইপাশে বেধে দেয়ালে পিঠ ঠেঁকিয়ে বলে ওঠে,” তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ তুমি কী করেছ। মামলি কোনো ব্যাপারের সাথে তুমি জড়িয়ে নেই আর সাধারণ কোনো কাজ করোনি। পুলিশ এখনো তোমার পিছনে পড়ে আছে, পড়ে আছে ফরহাদ সাহেবও। ফরহাদ সাহেবকে নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি, ভুলে যাওয়ার কথাও না। আমি তোমার সিকিউরিটির জন্য মেয়েটাকে তোমার সাথে রাখতে চেয়েছিলাম যেন সব খবরাখবর সে আমাকে সবসময় দিতে পারে। ”

আবরার থামতে না থামতেই এশা বলে ওঠে,” তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ ওই হারাম*জাদা আমার ভাইকে মেরেছিল। র*ক্তের বদলে র*ক্ত। আর আমি যদি কোনো বিপদেও পড়ি তাহলে কি ওই দুই টাকার মেয়ে আমাকে বাঁচাবে? ”
” সে দুই টাকার মেয়ে না, এশা। কথায় আন্তরিকতা রাখো।”
” তুমি আমাকে এখন কথাবার্তা শেখাবে? যাও বেরিয়ে যাও তো এখান থেকে৷ একদম জ্ঞান দিতে আসবে না, এটা আমার সবচেয়ে অপছন্দের। ”
” বড়োলোকের বিগড়ে যাওয়া মেয়ের মতো কথা বলবে না, এশা। হৃদিতাকে রাখা হচ্ছে তোমার সাথে থাকার জন্য বাকিটা আমি দেখে নেব। আমি যেভাবে বলছি সেভাবে চলো কয়েকটা মাস। পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে গেলে ওকে বাদ দেওয়া যাবে।”

এশা আবরারের দিকে এগিয়ে এসে আবরারের মুখ বরাবর আঙুল উঁচিয়ে বলে,” তোমাকে আমি নিষেধ করেছি আবরার। বেশি বাড়াবাড়ি করবে না। তুমি যে কথা বলছ সেটা আমি, তুমি, বাবা ছাড়া কেউ জানে না আর বাকি রইল পুলিশ তারা শুধু সন্দেহ করেছিল তাছাড়া কিছু না।”

আবরার ধৈর্য্যহীন না হয়ে আবার বলে,” নিজেকে নিয়ে একটু ভাবো, এশা। জীবনটা ছেলেখেলা নয়। তুমি হৃদিতাকে চাইছো না তাই না? আমি অন্যকাউকে ঠিক করে দিই।”
” তুমি জাস্ট এই রুম থেকে বেরিয়ে যাও সাথে আমার জীবন থেকে। তোমাকে সহ্য হয় না আমার।”
” ভেবে বলছো?”
” এতে ভাবাভাবির কী আছে? তোমারে ভাল্লাগে না এই কথা বাবাকে বলেছিও সে শুনেনি। আজ তোমাকেই বলে দিলাম। যাও বেরিয়ে যাও।”

আবরার টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে দ্রুতগতিতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আবরারকে বেরিয়ে আসতেই দেখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় হৃদিতা। আবরারের দিকে দুই এক পা এগিয়ে এসে বলে,” কী বলল উনি? আমাকে মাফ করতে পেরেছেন?”

আবরার হৃদিতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে ওঠে,” চলুন আমার সাথে। ”
” যাব কেন?”
” আমার কিছু করতে হবে না এখন?”
” এখন না কখনোই কিছু করতে হবে না।”
” ক্লিয়ারলি কিছু বলছেন না কেন?”

আবরার দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” চলুন আমার সাথে।”
____

আশরাফ দুইটা গহনার বাক্স নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই ময়না বেগম আশরাফকে নিজের রুমে ডেকে পাঠান৷ সুরাইয়া রান্নাঘরে কাজ করছিল। আশরাফ মায়ের ডাক শুনে মায়ের রুমে যাওয়ার আগে সুরাইয়ার দিকে তাকাতেই সুরাইয়া চোখ নামিয়ে কাজে মন দেয়। সে এই পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে জানে এখন কী ঘটবে। সবকিছু ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরাইয়া।

আশরাফ ঘরে ঢোকার পরই ময়না বেগমের চোখ যায় গহনার বাক্সের দিকে। হাত বাড়িয়ে বলেন,” দেখি কী এনেছিস?”

আশরাফ বাক্সের দিকে একবার তাকিয়ে মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,” সুরাইয়ার জন্য ছোটোখাটো কিছু উপহার নিয়ে এসেছি। বাহিরে থেকে আসার সময় তো কিছু আনতে পারিনি তাই ভাবলাম ওকে কিছু দেই। সে তো নিজে থেকে কিছু চাইতেই ভুলে গেছে। ”

ময়না বেগম একটা বাক্স খুলে ভেতরে স্বর্ণের দুজোড়া কানের দুল দেখে আরেকটা খুলে সেখানে দুইটা স্বর্ণের আংটি দেখতে পায়। সেগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলে ওঠেন,” এই সবগুলো বউয়ের জন্য?”
” হ্যাঁ মা, সুরাইয়ার জন্য নিয়ে আসলাম। ওকে তো তেমন কিছু দিতে পারিনি৷”
” মায়ের জন্য কী এনেছিস?”
” তোমার কিছু চাই? আমাকে বলো তোমার কী লাগবে?”
” আমি বলব তারপর নিয়ে আসবি?”
” না মানে, তোমার জন্য গতবার নিয়ে এসেছিলাম তাই আর আজ কিছু নিয়ে আসিনি। তোমার কিছু লাগলে বলো আমি নিয়ে আসছি।”
” লাগবে না। তোর বউয়ের গুলো আমার কাছে রাখতে বলিস। যখন কোনো অনুষ্ঠান হবে পরতে হলে তখন যেন নেয়, নিয়ে পরে। ”

আশরাফ মাথানিচু করে বলে,” মা, এগুলো প্রতিদিন ব্যবহার করার জন্য। এক জোড়া কানের দুল পরবে আর একজোড়া ও নিজেই রেখে দেব। যখন ইচ্ছে হয় পরবে। মেয়েদের গায়ে গহনা আলাদা শ্রী সৃষ্টি করে।”
” তোমার বউকে বোলো আমার থেকে নিতে। এত দামি জিনিস সামলাতে পারবে না।”

আশরাফ বুঝতে পারে এগুলো হয়তো সুরাইয়ার ভাগ্যে আর জুটবে না। মায়ের কাছে থাকলে সুরাইয়া নিজের ইচ্ছেমতো পরতেও পারবে না। সে বুঝে গেছে তার মা সুরাইয়াকে খুব একটা পছন্দ করে না। এই পরিবেশটাই একটা পুরুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন। মায়ের মন রাখলে বউ অখুশী আর বউয়ের মন রাখলে মা অখুশী।

আশরাফ কপাল চুলকে বলে,” মা, এগুলো সুরাইয়া পরে থাকবে। সামলে রাখার বা না রাখার কী আছে? ”
আশরাফ গহনাগুলো বাক্সে রেখে মায়ের হাত নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে বলে,” মা, সুরাইয়া পুরো সংসার সামলায়। রান্না থেকে শুরু করে বাজার, বাড়ির কাজ,তোমার সেবা, সবার দেখভাল সবই করছে। এতকিছু সামলাতে পারলে সামান্য এই গহনা সামলাতে পারবে না? কী যে বলো না! ”

আশরাফ বাক্সগুলো নিজের হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,” মা তুমি রেস্ট নাও আমি পরে আবার আসব।”

ময়না বেগম কিছু না বলে ছেলের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকেন৷ তিনি ছেলের পরিবর্তন বেশ বুঝতে পারছেন। সংসারটা হাত থেকে পিছলে যাচ্ছে ভেবে বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে ময়না বেগম। সুরাইয়ার প্রতি রাগ যেন এবার আরেকটু বড়ো আকার ধারণ করেন।

সুরাইয়া ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে নিজের রুমে চলে এসেছে। এক কাপ চা নিয়ে বসে বসে টিভি দেখছিল। পাশেই আরেক কাপ চা রাখা আশরাফের জন্য। চায়ে চুমুক দিতেই রুমে আশরাফের উপস্থিতি টের পেয়ে সেদিকে আর দেখে না আশরাফকে।

আশরাফ বুঝতে পারে সুরাইয়া রেগে আছে। আশরাফ গহনার বক্স দুইটা পাশের চেয়ারে আস্তে করে রাখে৷ সুরাইয়া সেটা বুঝতেও পারে না। সুরাইয়ার পাশে বসতেই সুরাইয়া অন্যদিকে সরে যেতেই আশরাফ হাত ধরে সেখানেই আটকে রাখে।

সুরাইয়া বিরক্তভাব নিয়ে বিরসভাবে আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,” কী চাই?”

আশরাফ মৃদু হেসে বলে,” হাতটা দাও।”
” কেন?”
” আংটি পরবে না? তোমার তো শখ ছিল। ”
সুরাইয়া ভ্রু কুচকে বলে,” তোমার মা রেখে দেয়নি? বলেনি আমি স্বর্ণ সামলে রাখতে পারব না?”
” মা’র কথা এতো ধরে বসে থেকো না তো। হাত দাও।”

সুরাইয়া হাত বাড়িয়ে দিয়ে আশরাফ পাশে রাখা বক্স থেকে দুইটা আংটি বের করে সুরাইয়ার আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বলে,” দেখো তো পছন্দ হয়েছে কি না?”

সুরাইয়া নিজের আঙুলের আংটি দুইটা পলকহীন চোখে দেখতে থাকে। বিষয়টা যেন অবিশ্বাস্য লাগছে তার কাছে। বাবা যে টাকা উপার্জন করত তাতে স্বর্ণ তো দূরের কথা তিনবেলা ঠিকমতো খেতেও পেত না। মা খুব কষ্ট করে কয়েক বছর টাকা জমিয়ে এক জোড়া কানের দুল বানিয়ে দিয়েছিল সেটাও বাবার অসুখের সময় বিক্রি করে চিকিৎসা করতে হয়েছিল। বিয়েতে যা গহনা পেয়েছিল সেটা বিয়ের পর শাশুড়ি দেখতেও দেয়নি।

সুরাইয়া টলমল চোখে আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,” এগুলো আমার?”
আশরাফ হেসে বলে,” কানের দুলও আছে।”
সে গহনার বক্সটা সুরাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ” এখানে দুই জোড়া আছে। যখন যেটা ইচ্ছে পরতে পারো। ”

সুরাইয়া কানের দুলজোড়া দেখে মুচকি হেসে বলে,” এগুলোর সাথে শাড়ি পরি? তোমার দেওয়া ওই লাল টকটকে শাড়িটা?”

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here