প্রিয়তার প্রহর পর্ব ৮

0
169

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (৮)

রাত ঘনিয়ে এসেছে। ঝি ঝি পোকারা ডাকছে বারবার। আকাশে মেঘ করেছে। তারাদের দেখা যাচ্ছে না। ইহানের মনে পরল ছোট বেলার কথা। আগে রাতে মেঘ উঠলে বুঝতে পারতো না ইহান। সহজ পদ্ধতিতে ইহানের মা রেহানা বলেছিলেন “রাতে যদি চাঁদ দেখতে না পাস, তাহলে বুঝবি মেঘ করেছে”। ইহান এটা মনে রাখে।

ইহান বা পাশে তাকিয়ে তানিয়াকে দেখল। ফার্মসির দোকানে বসে আছে তারা। ছোট একটি বিছানায় শুয়ে আছে তানিয়া। চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ডাক্তার কিছু ঔষধ আর মলম জাতীয় পদার্থ দিয়েছেন। দুটো ইনজেকশন দিয়েছে তানিয়াকে। প্রথমে ইনজেকশন নিতে চায়নি তানিয়া। ইহান ডাক্তারের সামনেই ভয়াবহ ধমক দিয়েছে তানিয়াকে। এরপর কোনকিছুতে না করেনি তানিয়া। একদম চুপচাপ শুয়ে ছিল। ইহান ডাকল তানিয়াকে। বললো,

” উঠবে না? এখানেই শুয়ে থাকবে? রাত হয়েছে।

তানিয়া চোখ মেলল। হাত ব্যথায় টনটন করছে। ভাগ্যিস গুলিটা গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে। যদি হাতে লাগত? তাহলে এখন হাসপাতালে থাকতে হতো। আগামীকাল প্রহর স্যারের বাসায় দাওয়াত আছে ওদের। প্রিয়তার বিষয়ের কেসটা নিয়েও খানিক ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। এ মুহূর্তে বিছানায় পরলে কাজগুলো কঠিন হতো।

তানিয়া উঠে বসল। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কল লিস্ট চেক করল। ইহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” প্রহর স্যার এখান থেকে বের হতে না করেছেন। উনি আসবেন বলেছেন। যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

ইহান কথাটা শুনে বেরিয়ে এলো বাইরে। রাস্তার সাথেই ঔষধের দোকান। ডাক্তার নিজেও বেশ আন্তরিক। এতক্ষণ তানিয়ার পাশের চেয়ারে ছোট্ট ঘরে যান্ত্রিক পাখা ব্যতিত বসে থাকতে ভালো লাগছিল না ইহানের। এখন বাইরে এসে নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে। প্রকৃতির মোলায়েম বাতাসে গা শিনশিন করে উঠছে। গুলিটা আরেকটু হলেই একদম ইহানের বুক বরাবর লাগত। ঠিক সময়ে হাসপাতালে না পৌছালে কিংবা গুলিটা ঠিক জায়গায় বসলে এখন ইহানের অস্তিত্ব থাকতো না। লাশ হিসেবে সকলের মুখে মুখে শোনা যেত ইহানের নাম। বিষয়টা মন্দ হতো না। কিছু মানুষ ভাবে মরণ সব সমস্যার সমাধান। ইহানের এই ভাবনা নেই। ইহানের মনে হয় সব সমস্যা মৃত্যুতেই শেষ হয়ে যায় না। কিছু সমস্যা মৃত্যুতেও তৈরী হয়।

পনেরো মিনিট বাদেই প্রহর বাইক নিয়ে ফার্মেসির সামনে এলো। ইহানকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মোটামুটি অবাক হলো প্রহর। বাড়িতে তিয়াশের গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হয়েছে একটু আগেই। আগামীকাল বিয়ের জন্য জোগাড়যন্ত্র চলছে। ইহান মেসেজ করেছিল অনেকক্ষণ আগে। শুধু বলছিল “জাফরের চ্যালারা আক্রমণ করেছে ওদের। তানিয়া আহত হয়েছে”। এরপর দ্বিতীয় মেসেজে ঠিকানা বলে দিয়েছিল। প্রহর বাইক থেকে দ্রুত নেমে ইহানের কাছে এলো। বললো,
” তুই এখানে? তানিয়া ঠিক আছে?

ইহানের চোখে মুখে কোন চিন্তার রেশ দেখতে পেল না প্রহর। ইহান স্বাভাবিক ভাবে বললো,

” সিরিয়াস কিছু হয়নি। গুলি হাত ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে।

প্রহর আর ইহান ফার্মেসিতে ঢুকল। তানিয়া নিয়াজকে ফোন করে ফিরতে দেরি হবে বলে জানিয়েছে। ফোনটা রাখতেই প্রহরকে আসতে দেখল ভিতরে। অভ্যেসবশত উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। প্রহর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বললো,
” আর ইউ ওকে তানিয়া? কিভাবে কি হলো?

ইহান বাঁকা হাসল। বললো,
” আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছে। এটা করার কোন মানে ছিল? ওরা আমাকে এট্যাক করতে চেয়েছে। সেখানে ও নিজে এগিয়ে এলো কেন? দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার কখনো এমনটা করে?

” দায়ীত্বশীল সদস্য স্যারকে বাঁচাতে এটুকু করেই। খুব নরম কণ্ঠে খোঁচা দিয়ে কথাটা বললো তানিয়া।

প্রহর জিজ্ঞেস করল,
“ওদের ভালোমতো দেখেছো তোমরা?

ইহান বললো,
” কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখতে পেয়েছি। মুখগুলো মনে পরছে না। ওদের দেখবো নাকি এই মেয়েটাকে সামলাবো? এটুকু বিষয়ে হাইপার হতে হয়? অজ্ঞান হতে হয়? এমন হলে বড় বড় অপরাধীদের কিভাবে ধরবে?

তানিয়ার রাগ হলো ভিষণ। রোজ রোজ এইভাবে অপমান করার কোন মানে আছে? সে ভুল কি করেছে? একজনকে গুলি করা হচ্ছে দেখেও সে চুপ থাকবে? স্যারকে এইভাবে আহত হতে দেখবে? এটা সম্ভব?

তানিয়া উঠল বিছানা থেকে। ফোনটা ব্যাগে ভরে নিল। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে উঠল,
” আমি ভুল করেছি তাইতো? আপনাকে আহত হতে দেখলে বেশি ভালো হতো তাইতো? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে বেশি খুশি হতেন? আমি এতটা নিষ্ঠুর নই স্যার। আপনি সবসময় অপমান করেন। আমি মেনে নিই। আর কত? আমি কোনকিছুই পারি না, কোনকিছুই বুঝি না, কোন কাজেই পটু হই। হয়েছে? আমি লেডি পুলিশ অফিসার হওয়ার যোগ্য নই। এটাই তো? বেশ মানছি আমি। আমাকে বাদ দেওয়া হোক।

তানিয়া কথাটুকু বলেই বেরিয়ে এলো। নির্বাক হলো প্রহর আর ইহান। আড়চোখে ইহানের দিকে তাকাল প্রহর। তানিয়ার পিছনে গিয়েও লাভ হলো না। একটা অটো ধরে উঠে পরল তানিয়া। পিছু ফিরে দেখল ইহান স্যারের মুখ। দেখতে পেল ভিতরের ক্ষত?

_________________

সকালে প্রিয়তার ঘুম ভাঙল গানের শব্দে। বিষয়টাতে বিরক্ত হলো প্রিয়তা। বিয়ে বাড়িতে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কালকের ঘটনার জন্য ও বাড়ির সবার প্রতি একটা আলাদা রাগ রয়ে গেছে প্রিয়তার। তারা যাই করুক তাতেই রাগ হচ্ছে। প্রিয়তা যতই বলুক মনে রাখিনি, ভুলে গিয়েছি, ভাবতে চাই না। আসলে প্রিয়তা কোনকিছুই ভুলেনি। আর না ভুলতে চায়।

প্রিয়তা সকালে উঠে রান্না বান্না করল না। ঘরে বাজার নেই। দুপুরে টিউশনি করে ফিরে আসার সময় বাজার করে আনবে। আরহামকে কথা দিয়েছে আজ ভালো ভালো রান্না হবে ঘরে। কথা তো রাখতেই হবে। দোকান থেকে কিনে আনা পাউরুটি আর কলা দিয়ে সকালের নাস্তা করলো প্রিয়তা আর আরহাম। খেয়েদেয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রিয়তা বললো,

” কাল যা হয়েছে তা তোমার জানা উচিত আরহাম। ও বাড়িতে একটা দামী আংটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওরা বলেছে তুমি কিংবা আমিই আংটিটা নিয়েছি অর্থাৎ আমরা চুরি করেছি। চুরি করা কত বড় অন্যায় তা তো তুমি জানোই। এত বড় অপবাদ বহন করার পর তুমি যদি ও বাড়ি যাও তাহলে তোমার ব্যক্তিত্ব নষ্ট হবে, আত্মমর্যাদা ভেঙে খান খান হবে। ব্যক্তিত্ব বা আত্মমর্যাদা সম্পর্কে তোমার জ্ঞান লাভ করার বয়স হয়নি। তবে এটুকু মনে রেখো আমি তোমার ভালোই চাই। তোমার খারাপ হোক, তুমি কষ্ট পাও এমন কিছু আমি কোনদিনই চাইবো না। তাই আমি চাই তুমি উপরের ফ্ল্যাটে না যাও। এখন বাকিটা তোমার ইচ্ছে।

আরহাম পুরোটা শুনল। আদুরে ভঙ্গিতে আরহাম জড়িয়ে ধরল প্রিয়তার কাঁধ। চুমু খেল প্রিয়তার গালে। একটু হেসে দাঁত বের করে বললো,

” আমি ওখানে যাবো না। ওরা আমাদের কষ্ট দিয়েছে। তুমি তো আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে। আমি কেন ওখানে যাবো।

প্রিয়তা হাসল। অজস্র চুমু খেল আরহামের নরম গালে। ফোনটা রেখে গেল আরহামের কাছে। ভালো না লাগলে কার্টুন দেখবে ছেলেটা। প্রিয়তা বের হলো বাড়ি থেকে। গতকাল রাতেও একটা কল এসেছিল টিউশনির জন্যে। ছাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে। প্রত্যেকটা সাবজেক্ট কম-বেশী পড়াতে হবে। মাসিক বেতন ধরা হয়েছে তিন হাজার। প্রিয়তা হিসেব করলো মাস শেষে এগারো হাজার টাকা ইনকাম করবে সে। তা থেকে সাড়ে তিন হাজার ঘর ভাড়া, বিদ্যুত বিল,
ময়লা ফেলার বিলে চলে যাবে। বাকি সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে বাজারসদাই করতে হবে। সাথে আরহামের জন্য কিছু টাকা সঞ্চয় করতে হবে।

ব্যাচ আর কুসুম,কোয়েলকে পড়াতে পড়াতে দুপুর বারোটা বেজে গেল অনায়াসে। কুসুমদের বাড়ি থেকে রোজ হেঁটেই বাজার পার করে বাড়ি ফিরে প্রিয়তা। আজও আধ ঘন্টা হেঁটে বাজারে এলো সে। বাজারের চারদিকে মানুষে ভরপুর। পোল্ট্রি মুরগির জঘণ্য গন্ধ ভাসছে চারদিকে। নানা রকমের মাছের বিস্রি গন্ধে বমি পাচ্ছে প্রিয়তার। শনিবার হাটের দিন। শনিবারে বাজারে বেশি মানুষ আসে। সব রকমের তরি-তরকারি পাওয়া যায় বাজারটাতে। শনিবারে মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে কথোপকথনের আওয়াজ। পুরো বাজার জুড়ে এখন দর কষাকষির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দাঁড়ানোর জায়গা নেই একদম। বিক্রেতারা ডেকে চলেছে ক্রেতাদের। বাজার বসার জায়গাটা ভালো নয়। উঁচু নিচু জায়গাগুলোয় বৃষ্টি পরলে পা রাখা যায় না।

প্রিয়তা প্রথমেই মাংসের দোকানে গেল। প্রথমে ভাবল মুরগির মাংস নিবে। কিন্তু মনে হলো আরহাম গরুর মাংস বেশি পছন্দ করবে। বিয়ে বাড়িতে গরুই চলে। যদি ভাইটা তার জিজ্ঞেস করে গরুর মাংস কই? তখন কি বলবে প্রিয়তা?বাজারের জিনিসপত্রের দাম সম্পর্কে ধারণা নেই প্রিয়তার। মাংসের দোকানে ভিড় দেখে পাশেই দাঁড়াল কিছুক্ষণ। টাটকা মাংস কিনা বোঝা যাচ্ছে না। পুরুষদের জন্য জায়গাই হচ্ছে না। সবাই কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে তাকে। প্রিয়তা সময় নিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল,

” মাংস কত টাকা কেজি আঙ্কেল?

দোকানদার হেসে বললো,
” মাত্র সাতশো টাকা কেজি আপা। নিয়া যান।

প্রিয়তার মুখটা চুপসে গেল। এত টাকা দাম? ঘরে কোন মশলাপাতি ও নেই। মশলা কিনতেও খরচ হবে অনেক। মশলা ছাড়া তো মাংস ভালোই লাগবে না। আরহামের মুখটা মনে পরল প্রিয়তার। ছেলেটা অপেক্ষা করছে তার জন্য। গিয়ে রেঁধে, খেয়ে আবার বের হতে হবে । দোকানদার তাড়া দিল। প্রিয়তা এক কেজি মাংস নিল। এক হাজার টাকা দিল দোকানীকে। দোকানদার তিনশো টাকা ফেরত দিল। প্রিয়তা চটপট ছুটল মুদির দোকানে। লবঙ্গ, দাড়চিনি, রসুন সহ কিছু মশলা কিনল। সবকিছুর দাম আকাশ ছোঁয়া। আলুর কেজি ষাট টাকা। পেয়াজের দাম ও অনেক। সবকিছুর দাম শুনে মাথা ঘুরাচ্ছে প্রিয়তার। একশো টাকার নিচে বাজারই নেই তেমন। যে সবজি প্রিয়তা ছুঁয়েও দেখতো না সেসবের দাম এখন ব্যাপক। সেগুলো কিনে খাওয়ার মতো বিলাসিতা নেই এখন। টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার অভাবে বুকের ভেতর মোচর দিল প্রিয়তার। বুঝতে পারল জগত সংসারে টিকে থাকতে হলে অর্থ জিনিসটা খুব জরুরি, অনেক প্রয়োজন। আয়ের চেয়ে ব্যয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেই বেহাল দশা হচ্ছে। এভাবে চললে কিভাবে বাঁচবে জনগন? দরিদ্র মানুষ খাবে কি? কতশত মানুষ বাজারে এসে দাম শুনেই ফিরে যায়। এদের দুঃখ কবে ঘুচবে? যা যা দরকার তাই তাই কিনল প্রিয়তা।
ফিরে আসার পথে প্রিয়তার মিষ্টি জাতীয় কিছু নেওয়ার কথা মনে পরল। বিয়ে বাড়িতে খাওয়ার পর দই খাবারটা খুব চলে। প্রিয়তা ততক্ষণাৎ মিষ্টির দোকানে ঢুকল। দইয়ের ছোট খুঁটি কিনলো তিনশো টাকা দিয়ে। অতঃপর হাসিমুখে বেরিয়ে পরল বাজার থেকে। আরহাম আজ খুব খুশি হবে।

_____________

বাড়িতে ফিরে তাড়াহুড়ো করে ভাত বসিয়ে দিল প্রিয়তা। আলু কেটে নিল। মশলা গুলো বেঁটে নিল সময় নিয়ে। ব্যাগ থেকে মাংসের পলিথিন বের করল প্রিয়তা। বাটিতে ঢালল মাংসটুকু। মাংস টুকু বের করতেই প্রিয়তার উজ্জল মুখ ফ্যাকাশে হলো। দোকানদার মাংসের চেয়ে তেল আর হাড় দিয়েছে বেশি। প্রিয়তা গুনে দেখল এখানে ছোট ছোট একুশ টুকরো মাংস আছে। এর মধ্যে হাড় আর তেল বাদ দিলে ভালো মাংস পাওয়া যাবে মাত্র বারো-তেরো টুকরা। এই মাংস আরহামের একারই লাগবে।
প্রিয়তা আর ভাবার অবকাশ পেল না। আরহামের খিদে পেয়েছে। প্রিয়তা মাংস বসিয়ে দিল। মাংস কষাতে কষাতে আরহাম রান্নাঘরে এলো। বললো,

” খুব ঘ্রাণ বেরিয়েছে আপু। খেতে টেস্টি হবে অনেক। দেখেই আমার লোভ লাগছে।

প্রিয়তা হাসল। নেড়ে দিল মাংস। বললো,
” কষানো মাংস খাবে আরহাম?

আরহাম যেন এ কথাই শুনতে চাইছিল। মুখে হাসি ফুটল ছেলেটার। দৌড়ে ঘর থেকে ছোট একটা বাটি নিয়ে ফিরে এলো রান্নাঘরে। প্রিয়তা দু টুকরো মাংস তুলে দিল বাটিতে। গ্যাসের চুলার পাশের উঁচু জায়গায় বসে আরহাম ফু দিয়ে দিয়ে মাংসটুকু দাঁত দিয়ে ছিড়ে খেল। খাওয়া শেষে একটু ঝোল চেটে খেয়ে বললো,

” খুব মজা হয়েছে আপু। এত মজা আগে তো লাগেনি। তুমি অনেক ভালো রান্না করো।

প্রিয়তা হাসল। আরো এক টুকরা মাংস তুলে দিল আরহামের বাটিতে। আগে ও বাড়িতে কেজি কেজি মাংস আনতো আরিফ। তখন অত খেতে ইচ্ছে করতো না। আসলে কোনকিছু বেশি থাকলে আমরা তাতে আগ্রহী হই না। এক জিনিস খেতে খেতে রুচি চলে যায়, ইচ্ছে চলে যায়। এত ছিল বলেই তখন এত মজা লাগেনি। আজ এই কয়েকটা মাংস দেখেই বোধহয় বেশি ভালো লাগছে খেতে। প্রিয়তা অভিমান করে বললো,

” প্রথমে তো তুমি আমার রান্না খেতেই পারতে না আরহাম। আজ এত ভালো লাগছে?

” সত্যিই আপু। আজ বেশিই মজা লাগছে। সবকিছু পারফেক্ট দিয়েছো। একটু ঝাল ঝাল হয়েছে। তোমার রান্না সেইইই।

প্রিয়তা হাসল। আজ সে একদম মন দিয়ে রান্না করেছে। নিজের সর্বস্ব ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছে রান্নায়। তাই বোধহয় আজ আরহাম এত পছন্দ করছে তার রান্না। প্রিয়তা ভেবে নিল সব কটা টুকরোই আরহামকে আজ আর কাল সকালে খাওয়াবে। দই টুকু কারো ফ্রিজে রেখে দু দিন খাওয়াবে ছেলেটাকে। কোনমতেই ছেলেটার যেন মনে না হয় তারা অভাবে আছে।

_________________

বিছানায় শুয়ে আছে তানিয়া। মাথা ব্যথার পাশাপাশি হাত ব্যথা করছে। গতকাল ইহান স্যারকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে এখন খারাপ লাগছে তানিয়ার। সিনিয়ররা এমন করেই জুনিয়রদের নিয়ন্ত্রণ করেন, বকাঝকা করেন। এতে এতটা হাইপার হলে নিজেরই ক্ষতি। এছাড়া ইহান তার কথা আদৌ গায়ে মেখেছে কি না এতে সন্দেহ আছে তানিয়ার। শুধু শুধূ বলে দিল কথাগুলো। না জানি দুজন কি ভাবছে তাকে নিয়ে?

আবিরকে কিচ্ছুটি জানায়নি তানিয়া। রাতে ছেলেটা নাকি এ বাড়িতে খেতে আসবে। তখনই না হয় নিজের চোখে দেখবে। এখন ফোন দিয়ে এসব বললে হাজারটা প্রশ্ন করবে আবির। যা হয়েছে তা তো হয়েছেই। এখন লোকগুলোকে ধরতে পারলেই শান্তি পাওয়া যাবে।
তানিয়ার ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে উঠল। নিয়াজ ঘুমোচ্ছে এই সময়। দুপুরে না ঘুমোলে শান্তি লাগে না বয়স্ক লোকটার। তানিয়ার দুপুরে ঘুম আসে না। রাতে আসলেও ঘুমোতে পারে না মন মতো।

তানিয়া উঠল বিছানা ছেড়ে। চশমা পড়ে নিল। ওড়না জড়িয়ে দরজা খুলে চমকাল ভিষণ। ইহান আর প্রহর দাঁড়িয়ে আছে তানিয়ার সামনে। এতদিনের পরিচয়ে কখনো বাড়িতে আসেনি ইহান বা প্রহর। তানিয়া বলে কয়েও নিয়ে আসতে পারেনি ওদের। আজ যে ওরা আসবে তা ভাবতেও পারেনি তানিয়া। কয়েক পল চেয়ে তানিয়া সালাম দিল। ভেতরে আসতে বললো দুজনকে। দরজা লাগিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে বসতে দিল। তানিয়া জিজ্ঞেস করলো,

” স্যার, আপনারা চা খাবেন নাকি কফি?

প্রহর হাসল। বললো,
” ব্যস্ত হয়ো না। আমরা তোমাকে দেখতে এসেছি। কেমন আছো তুমি? হাতের কন্ডিশন ভালো?

” ঠিক আছি স্যার। সামান্য লেগেছে। কি খাবেন বলুন। নিয়ে আসছি।

ইহানের দিকে তাকাল তানিয়া। উহু, বিন্দুমাত্র বদলায়নি ইহান। একইরকম গম্ভীর ভাবে বসে আছে। তানিয়াকে দেখে নিল ইহান। স্পষ্ট স্বরে বললো,

” এখানে বসো। কোথাও যেতে হবে না।

তানিয়া শুনল। দুরত্ব বজায় রেখে চেয়ার টেনে বসলো ইহান আর প্রহরের সামনে। প্রহর বললো,

“ইহানের কথায় কিছু মনে করো না। ইউ নো যে ও এমনই। একটু গম্ভীর আর রাগী প্রকৃতির। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে…

‘ কাজের ক্ষেত্রে উনি কখনো ভুল করেন না। কখনো পিছ পা হন না। দায়িত্ব পালন করতে উনার কখনো দ্বিধা বোধ হয়নি, ভয় হয়নি। তাইতো স্যার? হাসি মুখে কথাটা বললো তানিয়া।

প্রহর হাসল। বললো,
” আমার চেয়ে তুমি এটা ভালো জানো।

ইহান গম্ভীর স্বরে বললো,
” তুমি আমাদের দলের সদস্য। তোমাকে সেভ করা আমাদের দায়িত্ব। সেসময় প্রহর ছিল না। আমি তোমাকে নিজ দায়িত্বে ওখানে নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু কি হলো বলো তো? আমার জন্য তোমাকে আঘাত পেতে হলো। এ বিষয়টা আমাকে সেনসিটিভ করে তুলেছে। আমি চাই না আমার জন্য কারো কোন ক্ষতি হোক। আমি চাই না আমার জন্য কারো কষ্ট হোক।
মনে আছে তানিয়া আমাদের আলাপের কথা? কনকনে শীতের মাঝে পাহাড়ি অঞ্চলে ট্রেনিং চলছিল আমাদের। আমার আর প্রহরের মতো তুমিও ট্রেনিং নিতে এসেছিলে। দৌড় প্রতিযোগীতা চলছিল। প্রহর প্রথমে ছিল, আমি দ্বিতীয়তে। হুট করে একটা ছেলে আমার দিকে পা বাড়িয়ে আমাকে ফেলে দিল। ছেলেটা আমাদের মতোই পুলিশ হবার ইচ্ছে নিয়েই এসেছিল ট্রেনিংয়ে। অসংখ্য প্রতিযোগীতা,পরিক্ষা দেওয়ার পর পুলিশ হিসেবে সিলেক্ট হয় খুব কম সংখ্যক মানুষ। আমি হোঁচট খেয়ে পরে গেলাম। প্রহর চলে গিয়েছিল অনেকটা দূরে। পিছু ফিরে আসতে চেয়েছিল। আমি চিৎকার করে বলেছিলাম “আসতে হবে না তোকে। তুই এগিয়ে যা”।

আমার বাক্য শেষ হতেই তুমি কোথা থেকে এলে। তোমার সাথে ছিল ফাস্ট এইড বক্স। আমার হোঁচট খেয়ে ছিলে যাওয়া পায়ে স্যাভলন দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলে তুমি। আমাকে টেনে তুলে বেঞ্চে বসালে। টুকটাক পরিচয় হলো আমাদের। একসাথে ট্রেনিং নিলাম আমরা। দৌড়, লাফানো, টার্গেট অনুযায়ী শুট, সাঁতার, সাইকেল রেসিং সবকিছুতেই আমরা তিনজন একসাথে অতিক্রম করলাম। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল ফাইনাল ট্রেনিংয়ে। অসংখ্য মানুষের মাঝে দুর্ভাগ্যের কারণে তুমি জাম্প এক্সামে পাশ করতে পারলে না। সে কি কান্না তোমার। সব ছেড়েছুড়ে চলে আসতে চেয়েছিলে, পুলিশ হওয়ার ইচ্ছে মুছে ফেলেছিলে মন থেকে। আমি আর প্রহর তোমাকে সান্ত্বনা দিলাম। অনেক বুঝিয়ে বললাম। তুমি মনকে নিয়ন্ত্রণ করলে। পরের বছর আবার ট্রেনিং এ আসবে বলে শপথ করলে। আমি আর প্রহর সব পরিক্ষায় পাশ করে সিলেট সদর থানায় জয়েন করলাম। তোমার সাথে আমাদের দুরত্ব বাড়ল। আমরা তোমার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখলাম। আমি এই একবছর খুব করে চেয়েছি তুমি পুলিশ হও। পরের বছরে তোমাকে পুলিশ হিসেবে দেখতে চেয়েছি আমরা। এক বছর পর তুমি সত্যিই এলে এই থানায়। অবাক হয়েছিলাম আমি। সাথে খুব খুশিও হয়েছিলাম। যা যা সাহায্যের দরকার ছিল তোমার সবকিছুই বুঝিয়ে দিলাম। সব রকমের পরিচালনা করার পর তুমি আমাদের টিমে এসেই পরলে। তোমার স্বপ্ন তুমি অন্যায় মুছে ফেলবে দেশ থেকে। তুমি চাইতে পুলিশ হয়ে সবার সাথে থাকতে। তুমি বলতে পুলিশকে যেন বারবার ফোন করতে না হয় এজন্য তুমি সবসময় এগিয়ে থাকবে। তোমার ইচ্ছে, উদ্দেশ্যে, সাহস তোমাকে এখানে এনেছে।

এটুকু বলে থামল ইহান। পুনরায় বললো,
” আজ যদি তোমার কিছু হতো তো আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। আমি রাগারাগি করি যেন তুমি তোমার উদ্দেশ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে না পারো। আমি রাগারাগি করি যেন তুমি তোমার কাজে আরো বেশি একটিভ হও, পথদ্রষ্ট না হও। গতকাল যা হলো তাতে আমি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছি। আজ কেন এসেছি বলি? তোমার দুঃখ এইবার ঘুচবে। আর বকবো না আমি তোমায়। আমাকে আর তোমার ভয় পেতে হবে না। সামনে মাসে আমি অন্য থানায় ট্রান্সফার হচ্ছি। আমার বদলে অন্য কেউ আসবে তোমাদের টিমে। তাই ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে এলাম। আমার উপর রেগে থেকো না।

তানিয়া এতক্ষণ সবটা শুনল। শেষের কথাগুলো শুনে আঘাত পেল ভিষণ। গতকালকের কথাগুলো তবে ইহান স্যারের গায়ে লেগেছে। তানিয়ার হুট করে এমন আচরণ ইহানকে অন্যরকম করে তুলেছে। তবে কি তার উপর রাগ করেই চলে যাচ্ছে ইহান? মনে সংশয় দেখা দিল।

তানিয়া প্রশ্ন করলো,
” আপনি কি আমার উপর রাগ করে চলে যাচ্ছেন?

তানিয়া মাথা নিচু করে আবারো বললো,
আমি সত্যি ওভাবে বলতে চাইনি। আমি একটু বেশিই রেগে গিয়েছিলাম। সরি স্যার।

প্রহর জানাল,
” ইহানের ট্রান্সফার সার্কিফিকেট অনেকদিন আগেই এসেছিল। কিন্তু ও অতটা আমলে নেয়নি। এখন জরুরী কারনে ওকে প্রয়োজন। ইতিশা ম্যামের কেসটা ডিশমিশ হলে আরো একটা কেসে ইনভল্ভ্ড্ হতে হবে। এরপর ওকে চলে যেতে হবে।

তানিয়ার খারাপ লাগল। কান্না পেল একটু। এভাবে বলা ওর উচিত হয়নি। একটু রাগ কমালে হয়তো এতটা খারাপ লাগতো না তানিয়ার। ইহান স্যার চলে গেলে তানিয়াকে গাইড করবে কে?

_____________________

পুরো ফ্ল্যাটের চারদিকে লাল-নীল রঙের লাইট লাগিয়েছে। বক্সে সুন্দর গান বাজছে। ইতিমধ্যে নিধি একবার এসে আরহাম আর প্রিয়তাকে ডেকে গিয়েছে। দুজনের কেউই যায়নি সেখানে। মনক্ষুণ্ণ হয়ে বারবার ফিরে গিয়েছে নিধি।

প্রিয়তা গোসল করে সাদা আর আকাশি রঙের মিশেলে গোল ফ্রক পড়েছে। চোখের পাতায় নিয়েছে আইলাইনার। ম্যাচিং করে ওড়না পরে চুল ছেড়ে দিয়েছে। প্রিয়তার প্রিয় কার্টুন হলো ডোরেমন। ডোরেমন কার্টুনের সিজুকা চরিত্রটি প্রিয়তার খুব পছন্দের। সিজুকার সামনের চুল কাটা দেখে প্রিয়তা নিজেও পার্লারে গিয়ে ওইভাবে চুল কেটেছে। সিল্ক আর পাতলা বলে এই হেয়ার স্টাইলে পুতুলের মতো লাগে প্রিয়তাকে।

আরহামকে প্রিয়তার সাথে ম্যাচিং করে সাদা শার্ট আর আকাশি প্যান্ট পরানো হয়েছে। দুজনকে একসাথে চমৎকার লাগছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে প্রিয়তা দইয়ের খুঁটি নিচের ফ্ল্যাটের আন্টিদের ফ্রিজে রেখে এসেছে। প্রিয়তা শুধু আলু আর ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছে। বের হবার পূর্বে প্রিয়তা ব্যাগ আর ফোন চেক করল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মেইন গেটে পেরিয়ে বাইরে বের হলো তারা। আরহামকে নিয়ে শিশু পার্কে যাবে প্রিয়তা। একটা অটো ধরে সেখানেই যেতে লাগল তারা। পথে খুনশুটি হলো অনেক। বেশ কয়েকবার প্রিয়তার মনে হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে। কথাটা ভুল প্রমাণিত হলো কারণ আশপাশে সন্দেহ করার মতো কোন ব্যক্তি নেই। অটো থেকে নামতেই একজন লোক এসে দাঁড়াল প্রিয়তার সামনে। থতমত খেল প্রিয়তা। লোকটার পরণে ব্লেজার। বয়স পঞ্চাশের অধিক। আধপাকা দাড়ি গুলো স্টাইল করে কাঁটা। প্রিয়তাকে দেখে লোকটা বললো,

” তুমি প্রিয়তা না?

প্রিয়তা উত্তর দিল।
” জি আমিই, আপনি কে?

” আমি তোমার বাবার বন্ধু। লোকটা হেসে বলে উঠল।

“ও আচ্ছা। আমাকে ডাকলেন কেন?

” চলো হাঁটতে হাঁটতে বলি। এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায়?

” না। যা বলার এখানেই বলুন। ভয় বাড়ল প্রিয়তার।

দূর থেকে অনুসরণ করা ব্যক্তি পুলিশে কর্মরত। প্রিয়তার দিকে নজর রাখে সে। লোকটাকে দেখে ফোন দিল পুলিশ ইমন। বললো,

” প্রিয়তা মেয়েটা জাফর আলীর সাথেই আছে স্যার। আপনার সন্দেহ সত্য। ওরা কথা বলছে।

“কি বলছে শুনতে পাচ্ছো? বললো প্রহর।

” কিছুই শুনতে পাচ্ছি না স্যার। তানিয়া ম্যাম যে কিছু শুনতে পারবে তার ব্যবস্থা নেই। প্রিয়তা আজ ঘড়িটা পরেনি স্যার। কি করবো?

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here