প্রিয়তার প্রহর পর্ব ১০

0
170

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা ( ১০ )
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

ভয়াবহ এক ঘটনা ঘটছে বিগত কয়েক বছর ধরে। “ফুড অ্যান্ড কোল্ড” নামক বিখ্যাত কোম্পানি কেক, বিস্কিট এ কৃত্রিম ক্ষতিকর রং এবং রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে কেক ও বিস্কিটকে আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু করে তুলছে। যা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অসুস্থ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি সিলেটের বিখ্যাত লেখিকা ইতিশা নায়েমার বইয়ে প্রকাশ পেয়েছে “ফুড অ্যান্ড কোল্ড” কোম্পানির ওউনার জাফর আলীর ভালো মুখোশের আড়ালে থাকা অযাচিত মুখ। এছাড়াও বইটিতে আরো কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে। জানা গিয়েছে ইতিশা নায়েমার পুত্র ইব্রাহিম নিখোঁজের পেছনে জাফর আলীর হাত রয়েছে। এ সম্পর্কে সিলেট সদর উপজেলার পুলিশ অফিসার আজওয়াদ ইশতিয়াক আমাদের জানাবেন। তার মুখেই আমরা এ তথ্যটির সত্যতা জানবো।

টিভিতে পরিপাটি করে শাড়ি পড়ে মার্জিত ভঙ্গিতে বসে থাকা মহিলাটি এতক্ষণ কথা বলছিলেন। তার কথা শেষ হতেই টিভির স্ক্রিনে ভেসে উঠল প্রহরের গম্ভীর মুখ। পাশেই ইহান আর তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে হাস্যজ্জল ভঙ্গিতে। সাংবাদিকরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে প্রহরের সামনে। সব পুলিশদের পরণে ব্লু রঙের শার্ট। কোমরে বন্দুক গুঁজে রাখা। পরিপাটি করে রাখা চুলগুলোর উপরে স্থান পেয়েছে পুলিশের ক্যাপ। সংবাদকর্মীর কথা শেষ হতেই প্রহর বলে উঠল,

” জাফর আলীর কেসটা নিয়ে অনেকদিন ধরে পুলিশ অফিসাররা ছুটছিল। এই কেসের কুল কিনারা পেয়েও যেন পাচ্ছিলাম না। ইতিশা ম্যামের সন্তান নিখোঁজের পর থেকে এ কেসটা আরো ভালোভাবে ঘাঁটতে আরম্ভ করি। অতঃপর সবটা মিলিয়ে গুছিয়ে বুঝতে পারি জাফর আলী এতে যুক্ত। রাসায়নিক পদার্থ লাইক হাইড্রোস ব্যবহার করে জনগনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে জাফর আলীর কোম্পানি। এ সম্পর্কে সব প্রমাণ আমরা উপরমহলের নিকট পেশ করেছি। আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন ইতিশা ম্যাম নিজেই। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তিনি অন্যায়ের সাথে মাথা নত করেননি। বরং সন্তানের চেয়ে দেশকে , দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন তিনি। দেশ ও দেশের মানুষকে বড়সড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। ইতিশা ম্যামের “দুর্নীতি” বইটা পড়লে আপনারা আরো অনেক কিছুই জানতে পারবেন। এই কেসটায় আমরা তিনজন ছিলাম। ইতিমধ্যে টিমের একজনকে এট্যাক করা হয়েছে। জাফর আলীর মুখে ইব্রাহিমের পরিস্থিতি খুব শীঘ্রই জানতে পারবো আমরা। ধন্যবাদ আমাদেয পাশে থাকার জন্য।

প্রহর ইহান আর তানিয়া ভিড় ঠেলে জিপের কাছে গেল। জিপের এক কোণে বসে আছে জাফর আলী। তাকে বের করে আনল প্রহর। হেসে বললো,

” আপনার এত এত প্ল্যান নষ্ট করার জন্য আমরা সত্যিই দুঃখিত। অন্যায়কারীকে সব সময় হেরে যেতে হয়।

জাফর আলী মোটেও দুঃখিত হলো না। হেসে ফেলল লোকটা। ধীর কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

“এক মাঘে শীত যায় না অফিসার। কতদিন আমাকে আটকে রাখবে। পুলিশ মানেই ঘুষ,জানো তো?

টেনে নিয়ে যাওয়া হলো জাফরকে। তানিয়া ভিত চোখে ইহানের দিকে তাকাল। বললো,
” উনি হয়তো বড় কোন পরিকল্পনায় নেমেছে স্যার। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

ইহান ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। থানার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। তানিয়ার কথা কুহরে পৌঁছানো মাত্র বললো,

” ও যদি প্ল্যান করে থাকে আমরাও তো বসে নেই। দেখা যাক কি হয়।

টিভিতে প্রহর ও তার টিমের জয়জয়কার চলছে। আনন্দে মেতে উঠেছে থানা। বড়সড় একটা কেস এত সহজে ডিশমিশ হবে কেউই ভাবতে পারেনি। মিসেস নাবিলা আনন্দে কেঁদে ফেলছেন। সাবিনা বেগম এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছিলেন। তিয়াশ ও তার বউসহ একটু পরেই গ্রামে ফিরে যাবেন তারা। যাওয়ার আগে ভাইয়ের ছেলের এমন সুন্দর মুহুর্ত দেখে খুশি হলেন তিনি। এনগেইজমেন্টের দিন থেকে নিধি ও প্রহর তার সাথে কথা বলে না। দেখা হলেও খানিক এড়িয়ে যায়। এ বিষয়টা বারবার আহত করছে তাকে। যাওয়ার আগে প্রিয়তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে প্রহর। কিন্তু এটা করলে যে মানসম্মান কমে যাবে তার। নিচু হবে পুচকে একটা মেয়ের সামনে। শেষ বয়সে এসে এমন এক অপমান? কি এমন বলেছে সে? আর মেয়েটার জন্য সবার দরদ উতলে পড়ছেই বা কেন?
_______________

শীত শীত ভাব এসেছে পৃথিবীতে। খুব ভোরে কুয়াশায় ঢেকে যায় দূরের স্থান। গা শিরশির করে ওঠে। সেইভাবে এখনো শীত পড়েনি। পাখা বন্ধ করলে গরম আর মশার জ্বালায় টেকা দায়। অপরদিকে পাখা ছাড়লেই শীতে জুবুথুবু অবস্থা। শীতের শাক-সবজি সেইভাবে উঠেনি বাজারে। তবুও শীত শীত আমেজটা উন্মুক্ত হচ্ছে। নতুন এক প্রকৃতির সাথে পরিচিত হচ্ছে মানুষ। গরমের উষ্ণতা কমিয়ে শীতকাল তেন মানুষের প্রাণে এক অজানা আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়।

প্রিয়তা সকালে উঠে নাস্তা বানিয়েছে ডিম ভাজা আর পরোটা। আরহাম খেয়ে পড়তে বসেছে। গতকাল রাতে পড়তে না বসায় সকাল হতেই ছেলেটার সামনে খাতা কলম রেখে দিয়েছে প্রিয়তা। পরোটা বানানো শেষ হতেই প্রিয়তা ঘরে এলো। আরহামের মুখে তুলে দিল পরোটার ছোট ছোট টুকরা। খেতে খেতে আরহাম বলে উঠল,

” আপু।

” বলো।

” আমি ব্যাট মিনটন খেলবো। বাইরে কত্ত জায়গা।

” তুমি তো পারো না ভাই। কেন আবদার করছো?

“তুমি তো পারো । আমাকে শিখিয়ে দিবে। তুমি কি বলো মনে নেই? পানিতে না নামলে সাঁতার শেখা যায় না, হোঁচট না খেলে হাঁটতে শেখা যায় না। কি বলো না?

হাসল প্রিয়তা। বাচ্চাটার মেধা এই বয়সে অনেকটাই ভালো। পড়ালেখা করার সম্পূর্ণ ইচ্ছে আছে আরহামের। প্রিয়তা কোনকিছু বললে ছেলেটা মনে রাখে। পালন করার চেষ্টা করে। সর্বক্ষণ এটা ওটা জিজ্ঞেস করতেই থাকে। জানার কৌতুহল আরহামের অনেক আগে থেকেই। ভাইয়ের এহেন কথায় গাল টিপে দিল প্রিয়তা। আরেকটা পরোটার টুকরো মুখে গুঁজে দিয়ে বললো,

” শীত ভালো মতো পড়ুক। কিনে দিবো। ও বাড়ি থেকে তো কিছুই আনা হয়নি।

” না আপু। আমি আজই খেলবো। তুমি এনে দাও না। নইলে আমাকে নিয়ে যেও ও বাড়িতে। আমি নিয়ে আসবো।

প্রিয়তার আত্মা কেঁপে উঠল। ও বাড়ি যাওয়ার কথা ভুলেও আরহামের মাথায় ঢোকানো যাবে না। গেলে হয়তো আর আসতেই চাইবে না ছেলেটা বাবাকে ছেড়ে। আর প্রিয়তা তো আরহাম ছাড়া থাকতেই পারবে না। খানিক নিচু স্বরে থমথমে মুখে আরহামকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিল প্রিয়তা। বললো,

“টিউশন থেকে আসার পথে কিনে আনবো।

আরহাম খুশি হলো। পড়তে বসল আবার। খেয়াল করলে ছেলেটা বুঝতে পারতো প্রিয়তার মলিন মনোভাব। টাকা পয়সা হাতে নেই বললেই চলে। ছোট খাটো কম দামি ড়্যাকেট কিনতে গেলেও দুশো-তিনশো টাকা লাগবেই। এত এত খরচ হজম হচ্ছে না প্রিয়তার। বাজার সদাইয়ে হাত দেওয়া যায় না। আলুর কেজি আজ সত্তর টাকার নিচে নেই। পেয়াজ রসুনের দাম তরতর করে বাড়ছে। মাছের কথা তো ভুলেই গিয়েছে প্রিয়তা। কালকের গরুর মাংস পুরোটাই আরহামকে খেতে গিয়েছে। দই আজ বিকেলে ফ্রিজ থেকে বের করে আরহামকে দেবে। নিজে না খেয়ে কোনোভাবে ছেলেটার চাহিদা পূরণ করছে প্রিয়তা। শীত ঝেঁকে বসলেই শীতের পোশাক চাইবে আরহাম। সেগুলো কিনতেও কত খরচ। কিভাবে কি সামলাবে প্রিয়তা? কোন দিকে যাবে?
প্রিয়তা থালা-বাসন ধুয়ে ভাবতে বসল। হিসেব কষল সবকিছুর। মাথায় চিন্তা নিতে নিতে প্রিয়তা দূর্বল হয়ে পড়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। আগের থেকে রোগা দেখায় তাকে। তবুও যেন চিন্তা কমে না।

প্রিয়তা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তৈরী হলো। ফোনটা রাখল আরহামের কাছে। ভাইকে কিছু উপদেশ দিয়ে বের হওয়ার পূর্বেই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। প্রিয়তা দরজা খুলল একটু সময় নিয়ে। দরজার ওপাশে সাবিনা বেগমকে দেখে কিছুটা অবাক হলো প্রিয়তা। সাবিনা বেগমের মুখটাও থমথমে। প্রিয়তা ঘরে আসতে বলবে কি না ভেবে পেল না। আতিথেয়তা করতে চেয়েও কেন যেন মন তাতে সায় দিল না। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করলো,

” আপনি এখানে? কিছু বলবেন?

সাবিনা বেগম বাধ্য হয়ে এসেছেন এখানে। প্রহরকে তিনি নিজের ছেলের চাইতে বেশিই ভালোবাসেন। সেই ছেলে তার সাথে কথা বলে না। সকালে থানায় যাওয়ার আগে সাবিনাকে অনুরোধ করেছিল প্রিয়তার কাছে আসার জন্য, ক্ষমা চাওয়ার জন্য। তাইতো ক্ষোভ আর রাগ থাকা সত্বেও এখানে এসেছেন তিনি। প্রিয়তার কথার প্রতিত্যুরে তিনি বললেন,

” দেখো মাইয়া, তুমি আমার অনেক ছোট। আমি সেদিন যা কইছি কইছি। মনে রাইখো না। গায়ে মাইখো না। আংটি হারানোর শোকে কি থিকা কি কইছি নিজেও জানি না।

প্রিয়তা হাসল। এটুকু বলাতেই কি সব অপমান ফিরিয়ে নেওয়া যায়? কলঙ্ক মুছে দেওয়া যায়? প্রিয়তা ক্ষমা করতো, যদি ঘটনাটা শুধু তার সাথেই ঘটতো। এ ঘটনার সাথে আরহাম ও জড়িত। কি করে এত সহজে ভুলবে সে? কাঁধে ব্যাগটা ভালো করে চেপে প্রিয়তা বললো,

” আমি যদি এখন হেসে বলি আমি কিছু মনে করিনি, ভুলে গিয়েছি, মনে রাখিনি, তবে তা হবে আমার জীবনে বলা সবচেয়ে বড় মিথ্যে। আমি মিধ্যে বলি না আন্টি। আপনাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। আমি চাইলেও কোনকিছু ভুলতে পারবো না। না চাইতেও বারবার ওই ঘটনা আমার চোখে ভেসে ওঠে। তাই ভুলে যাবো, গায়ে মাখবো না এ কথা দিতে পারছি না। তবে আমি চেষ্টা করবো আপনাকে মন থেকে ক্ষমা করার। আজ আসি। আসসালামু ওয়ালাইকুম ।

প্রিয়তা জুতোর খটখট শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। সাবিনা বেগম থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এইটুকু মেয়ের এত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা? সাবিনা বিরক্ত হলেন বেশ। রাগে গা শিরশির করে উঠলো তার। কি এমন করেছে সে? দু কথা বললে কি হয়? বয়সে তো মেয়েটা ছোট। অথচ কথাবার্তা কি পাকা পাকা। এজন্যেই বাবার বাড়িতে টিকতে পারেনি। নিশ্চয় বাবা-মা এই আচরণের জন্যে মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

_______________

তানিয়া বাড়িতে বসেই জাফর আলীর বিরুদ্ধের কেসটা ক্লোজ করার কিছু তথ্য একত্রে করছে। নিয়াজ একটু আগেও দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ডেকে গেছেন তানিয়াকে। কাজে লেগে পরলে আর উঠতে মন চায় না তানিয়ার। কেননা উঠলে আর কাজে হাত লাগাতে ইচ্ছে করে না। অলসতা লাগে। আজকাল এই অলসতা যেন বেড়েছে। জাফরের কেসটা নেমে যেতেই নিজেকে স্বাধীন মনে হচ্ছে তানিয়ার। বাবার ডাকে এইবার বিরক্ত হয়েই খাবার টেবিলে বসল তানিয়া। নিয়াজ আজ কাতলা মাছ রেঁধেছে। প্রতিদিন রান্না করে তানিয়াকে তিনি একটা কথাই জিজ্ঞেস করেন “রান্না কেমন হয়েছে, ভালো না”?

কিন্তু আজ এই ধরণের প্রশ্ন করলেন না নিয়াজ। বিষয়টাতে খুব অবাক হলো তানিয়া। এই প্রশ্ন রোজ একবার না শুনলে মনে হয় কিছু একটা সমস্যা রয়েছে। রোজ এক প্রশ্ন করতে করতে নিয়াজের যেমন অভ্যেস হয়ে গেছে, তেমনি একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে তানিয়া। নিয়াজের এইরুপ পরিবর্তনে একটু ঘাবড়ে গেল সে। পুলিশে জয়েন করার পর নিয়াজের সাথে তার দুরত্ব বেড়েছে। আগের মতো বাবার সাথে আড্ডা দেওয়া হয় না তানিয়ার। এত এত কাজ করে রাতে আর ইচ্ছে হয় না বাবার সাথে গল্প করার। যদিও নিয়াজের সব কথাই শোনে তানিয়া। এই যেমন বিয়ের বিষয়টা। এই বিয়েটা তানিয়া পুরোপুরি মানতে চায়নি। হয়তো চাইলেই মানতে পারতো। কিন্তু কেন যেন মন, মস্তিষ্ক সম্পর্কটাকে জোড়ালো করতে পারেনি। তানিয়া খেতে খেতে নিয়াজের উদ্দেশ্যে বললো,

” জিজ্ঞেস করলে না রান্নার কথা?

নিয়াজ হাসলেন। বললেন,
” রোজ এক প্রশ্ন করি। তুমি তো রোজই বলো ভালো হয়েছে।

“ভালো হলে বলবো না? আমাকে তো রান্না করতেই দাও না।

“সারাদিন যে পরিশ্রম করো তার পর আর রান্নার ঝামেলা নিতে পারবে? বাবা হয়ে এটুকু কষ্ট যদি বুঝতে না পারি তাহলে কেমন বাবা হলাম?

তানিয়া নড়েচড়ে বসল। বললো,

” এত ভালোবাসো কেন বাবা? কতদিন
করবে এইভাবে?

” যতদিন বেঁচে থাকি ততদিনই করবো।

” একটা কথা বলতে চাই তোমায়। বলবো?

নিয়াজ মেয়ের দিকে তাকালেন। খেতে খেতে বললেন,
” অনুমতি চাইতে হবে না। নির্দ্বিধায় বলো।

” তুমি বিয়ে করো বাবা।

তানিয়ার এহেন বাক্যে বিদ্যুতের ঝটকা খেলেন নিয়াজ। খাবার মুখেই কেশে উঠলেন। তানিয়া দ্রুত হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল নিয়াজের সম্মুখে। কথাটা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছেন নিয়াজ। মেয়ের মুখে এমন কথা কোন বাবাই বোধহয় সহজ ভাবে নিতে পারে না। নেওয়ার কথাও নয়। কাশি কমলে তিনি ভালো করে দম নিলেন। বুকটায় একটা ব্যথা শুরু হলো এভাবে কেশে ওঠার কারণে। সময় নিয়ে তিনি বললেন,

“মজা করছো বাবার সাথে?

” মোটেই না।
শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল তানিয়া। পুনরায় বললো,

” তুমি লজ্জা পাচ্ছো বাবা। কিন্তু কথাটা বলতে আমার মোটেও লজ্জা লাগেনি। আম্মু মারা গিয়েছে প্রায় চৌদ্দ বছর হয়েছে। আমি তখন ছোট। দশ বছর বয়স মাত্র । তোমার সাথে আম্মুর যখন বিয়ে হয়েছিল তখন তোমার বয়স ছিল পনেরো, আম্মুর বারো। খুব কম বয়সে তোমাকে সংসারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আম্মুর সাথে তুমি খুব সুখেই ছিলে। সংসার জীবন তোমার সুন্দর ছিল। হুট করে জ্বরের ঘোরে মারা গেল আম্মু। আমি একা হয়ে গেলাম। আম্মুর সাথে তোমার সংসার জীবন ছিল এগারো-বারো বছরের। আম্মু মারা যাওয়ায় শুধু আমিই আম্মুর অভাববোধ করিনি। আমি দেখেছি তুমি নিজেও আম্মুর মৃত্যুতে একা হয়ে গিয়েছিলে। কষ্টে পেয়েছিলে ভিষণ। প্রায় রাতেই চোখের পানি ফেলতে। বিয়ে মানে শুধু দৈহিক চাহিদা নয় বাবা। বিয়ে মানে মনের শান্তিও। আমাদের প্রত্যেকের কিছু মৌলিক চাহিদা থাকে। এর মাঝে সুখের জন্য কাউকে কাছে রাখা এক ধরনের চাহিদা। একজন সবসময় পাশে থাকবে, সব কথা শুনবে, কেয়ার করবে, অসুস্থ হলেও দোয়া করবে এ কথা ভাবতেই তো ভালো লাগে তাইনা? স্ত্রী মানে যে শুধু সন্তানের জন্মদান তা কিন্তু নয়। স্ত্রী মানে জীবন সঙ্গি, যার সাথে জীবনের প্রত্যেকটি মুহুর্ত ভাগাভাগি করা যায়। আমি অফিসে থাকি,সময় হয় না। তুমি সারাদিন একা একা ঘরে বসে বইপত্র পড়। এই সময় তোমার একজন মানুষ প্রয়োজন যে তোমার খেয়াল রাখবে, যে তোমাকে সঠিকভাবে গাইড করবে, তোমার সুখ-দুঃখের কথা শুনবে মনোযোগ দিয়ে। তোমায় মানসিক শান্তি দেবে এমন কজন দরকার।

“কি বলছো তুমি? পাগল হয়েছো? উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন নিয়াজ। এমনটা তিনি ভেবেছেন আগে। কিন্তু এখন বিষয়টা অন্যরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বয়সে এসব মানায়?

” আমি জানি সৎ মা আমাকে ভালবাসবে না ভেবে তুমি বিয়ের কথা কখনো চিন্তা করোনি। নতুন মা আমাকে কিভাবে ট্রিট করবে এ চিন্তা মাথায় রেখে নিজের চাহিদা পূরণের কথা ভাবোনি। কিন্তু এখন দেখো, আমি স্বাবলম্বী হয়েছি। আর ছোট নেই আমি। দুদিন পর আমার বিয়ে হয়ে যাবে। আমি বেশিদিন এ বাড়িতে থাকবোও না। তুমি তো তখন পুরোপুরি একা হয়ে যাবে আব্বু। আমি আমার আম্মুর জায়গা কাউকে দিতে পারবো না, দিবোও না। কিন্তু তুমি চাইলেই সেই জায়গাটা অন্যকে দিতে পারবে। আমি চাই অন্তত শেষ বয়সে এসে তুমি ভালো থাকো। নিজের করে একটা মানুষ পাও, বাকিদের কথা না ভেবে নিজের কথা ভাবো। এই কথাটা আমি আগে বহুবার তোমায় বলতে চেয়েছি। কিন্তু আমি জানতাম আমার কথা ভেবে তুমি বিয়ে করতে চাইবে না। তাইতো থানায় নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করার পর এ কথাটা তোমাকে বলতে এসেছি। আমি জানি কোন বয়সটায় কি প্রয়োজন। শুধুমাত্র শারীরিক সন্তুষ্টির জন্য মানুষ বিয়ে করে এমনটা নয়। মানসিক সন্তুষ্টি বলেও একটা বিষয় আছে।

নিয়াজ চুপ করে রইলেন। তার ও ইচ্ছে হয়েছে একটা মানুষকে নিজের করে রাখতে। স্ত্রীকে তিনি অনেক ভালোবাসলেও মনের চাহিদা সবসময়ই তাড়া করেছে। সুখ-দুঃখের কথা বলার জন্য একটা মানুষের প্রয়োজন বোধ করেছেন। কিন্তু মেয়ের ভবিষ্যত ভেবে এতদিন সে পথে পা বাড়াননি তিনি। আজ মেয়ের এমন কথা শুনে যুবকের ন্যায় টগবগ করে ফুটল নিয়াজের ব্যক্তিসত্ত্বা। চুপচাপ টেবিল থেকে উঠে গেলেন তিনি। যাওয়ার আগে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তানিয়া সম্মতি পেল যেন। মুচকি হেসে বাবার হাতে হাত রাখল। নিয়াজ চলে যেতেই ফোনটা হাতে নিয়ে Ehan Sir এর নাম্বারে ডায়াল করল তানিয়া। ইহান কল ধরতেই তানিয়া উত্তেজিত, উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,

” স্যার আমি পেরেছি। আব্বুকে আমি বুঝিয়েছি। আমার মন বলছে আব্বু রাজি।

” বাহ্। অভিনন্দন।

” আপনি যা যা বলেছিলেন আমি সবই বলেছি। অ্যান্ড আব্বুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে আব্বু নিজেও এটা চাইতো মনে মনে। কখনও প্রকাশ করার সুযোগ পাননি।

” হয়তো। আঙ্কেলের জন্য এখন মেয়ে দেখো তাহলে। দায়িত্ব বাড়ল তোমার।

” হ্যাঁ তাই তো। এখন মিশন হলো নতুন মা। আপনি আমাকে হেল্প করবেন তো? এই বিষয়ে?

” একা একাই চেষ্টা করো তানিয়া। তুমি পারবে।

” কিন্তু কেন স্যার? আপনি থাকবেন না? মন খারাপ হলো তানিয়ার।

” আমি তো সবসময় থাকবো না তানিয়া। নিজেকে এমন ভাবে গড় যেন আর কাউকে প্রয়োজন বোধ না হয় জীবনে।

তানিয়া হাসল। বললো,

” একা একা বাঁচা যায় না স্যার। এই প্রথম আপনার কথায় একমত হতে পারছি না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে কারো না কারো সাহায্য প্রয়োজন পড়েই। কোন মানুষই সব গুনের অধিকারি হতে পারে না। তাকে অন্যের কাছে যেতেই হয়। একা একা কোন কিছুতেই জয়ী হওয়া যায় না।

_____________________

বাড়ি ফেরার পথে তন্ময়ের সাথে হাঁটতে লাগল প্রিয়তা। ছেলেটার সাথে অনেকদিন ভালো মতো আড্ডা দেওয়া হয় না, কথা বলা হয় না। তন্ময় মুখিয়ে থাকে প্রিয়তার সাথে কথা বলার জন্য। তন্ময়ের দু কাঁধে ব্যাগ। শার্ট প্যান্টের সাথে ইন করা। চুল পরিপাটি করে গোছানো। তন্ময় ছেলেটা সুদর্শন। কিন্তু মাঝে মাঝে ছেলেটাকে হাবাগোবা মনে হয় তার স্টাইলের কারণে । হাউয়াই মিঠাই মুখে দিয়ে প্রিয়তা বললো,

” তোর কি খবর দোস্ত? মাঝরাতে ফোন বিজি দেখায় কেন?

তন্ময় থতমত খেল। প্রিয়তাকে এ নিয়ে সে কিছু বলতে চায় বুঝতে পারলো প্রিয়তা। উদগ্রীব চাহনি নিক্ষেপ করলো ছেলেটার দিকে। তন্ময় বললো,

” আমার হয়ে একটা টিউশনি করবি প্রিয়তা?

প্রিয়তার কপালে ভাঁজ পরল। এই ছেলেটা বলে কি? নিজেই কয়েকটা টিউশনি করে হাত খরচ চালাতে পারে না। আবার একটা টিউশনি প্রিয়তাকে দিয়ে দিতে চাচ্ছে? প্রিয়তা বলে উঠল,

” আমার একটা ব্যাচ আর দুটো টিউশনি আছে। তোকে আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুই তোর টিউশনি আমায় কেন দিবি?

তন্ময়ের মুখটা ছোট হয়ে গেল। ছেলেটা কিছু ভাবছে অনবরত। আগের মতো উৎফুল্ল ভাবটা নেই। কেমন মিইয়ে গেছে। প্রিয়তার কথার উত্তরে বললো,

” আমি টিউশনিটা ছেড়ে দিবো। তাই তোকে বলছি। না নিলে আর কি করার?

” কিন্তু ছাড়বি কেন? ততক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো প্রিয়তা।

” আমি যেই মেয়েটাকে পড়াই সেই মেয়েটা মুসলিম। মেয়েটা নাকি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এইটা কোন কথা হলো বল? ও মুসলিম আর আমি হিন্দু। এইসব তো কোনদিন সম্ভব না। রোজ রাতে কল দেয় মেয়েটা। পাগলামি করে। আমি ওকে বোঝাতে পারি না।

অবাক হলো প্রিয়তা। বললো,

” কি বলছিস?

” হ্যাঁ রে। মেয়েটা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। ওর নাম রিয়া। ইন্টারে পড়াশোনা করে। ধনী পরিবারের মেয়ে। পড়াশোনা একদমই করতে চায় না। ওর বাবা আমাকে টিউটর হিসেবে নিযুক্ত করেছে। কয়েক মাস যেতেই আমি বুঝতে পারি রিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি আমার প্রতি স্বাভাবিক নয়। রিয়া ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। আমার এখন ওর কাছ থেকে সরে আসা উচিত। আমি এটা কোনমতেই সম্ভব হতে দিতে পারি না। বারবার বুঝিয়েছি ওকে। কোন লাভ হয়নি।

প্রিয়তা ভড়কাল। কি বলবে এখন ও? হিন্দু মুসলিমের প্রেম বা বিয়ে সম্পর্কে ওর ধারণা নেই। তাছাড়া এই বিষয়টিও দৃষ্টিকটু। মুসলিম হয়ে অন্য ধর্মের ছেলেকে ভালোবাসবে, বিয়ে করবে এটা মানানসই নয়। কেউই কারো ধর্ম ত্যাগ করতে পারবে না। তন্ময় ভালো ছেলে। হিন্দু হলেও কখনো প্রিয়তার সামনে ভগবানের নাম নেয়নি। বলতে গেলে ভগবান আর আল্লাহ্- দুটোকেই মোটামুটি মানে ছেলেটা। যখন প্রিয়তার সাথে থাকে তখন আল্লাহ্কে নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। প্রিয়তার আড়ালে কি করে তা প্রিয়তার জানা নেই।

ভাবতে ভাবতে দুজন হাঁটতে লাগল। পরিস্থিতি ভিন্ন হলো। একটু আগে দুজন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আর এখন নিশ্চুপ। প্রত্যেকটি মানুষের কোন না কোন জটিল সমস্যা থাকেই। সমস্যা ছাড়া কোন মানুষই নেই পৃথিবীতে। তন্ময় সবসময় ফ্রি আর রিল্যাক্স থাকতে চাইতো, অথচ ছেলেটাকে এখন কি সব চিন্তা মাথায় রাখতে হচ্ছে। প্রিয়তা রাস্তা ক্রস করার জন্য ডায়ে বামে তাকাল। একটা মাইক্রো আসতে দেখলো ডান পাশ থেকে। কি মনে করে প্রিয়তা বায়ে তাকিয়ে আবার গাড়িটির দিকে চাইল। গাড়িতে থাকা মানুষগুলোকে দেখে প্রিয়তার মন আরো বিষিয়ে গেল। ছুপসে গেল মুখমণ্ডল। গাড়ির আয়নায় দেখতে পেল প্রীতিলতার হাস্যজ্জল মুখ। স্বামীর সাথে বোধহয় ঘুরতে বেরিয়েছে। প্রিয়তা নিজেকে আড়াল করলো কোনরকমে। মন চাইল ছুটে গিয়ে মায়ের সাথে গল্প করতে। কিন্তু মনকে প্রশ্রয় দেওয়ার কথা মাথায় আনল না প্রিয়তা। আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখল। মায়ের সুখ দেখে ভালোই লাগল তার। একটা অপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখছিল দুজন। আজ তারা মুক্ত, দুজন দুদিকে পা বাড়িয়েছে দ্বিধা ছাড়াই। প্রিয়তা হেসে বিড়বিড় করে বললো,

” নারীরাই নারীদের সবচেয়ে বড় শত্রু। নারী যেমন একটি সংসারকে পরিপূর্ণ করে, তেমনি এক নিমিষে একটি সংসারকে তছনছ করে দিতে পারে।

পুনরায় বললো,

” তুমি সুখে থাকো মা। এত এত সুখ তোমার সহ্য হোক।

___________________

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here